IQNA

'আমার সমস্ত আশা আর স্বপ্নকে পুড়িয়েছেন সু চি'

13:48 - October 15, 2017
সংবাদ: 2604070
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ২৬ বছর বয়সী রোহিঙ্গা তরুণ রো মাইয়ু আলী। হতে চেয়েছিলেন একজন লেখক। নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছিলেন প্রিয় পাঠাগার। সেনাদের দেওয়া আগুনে হারিয়েছেন সেই লাইব্রেরি। স্বপ্ন পুড়ে নিঃশেষ হওয়ার পর তিনি এখন ঠাঁই পেয়েছেন কুতুপালংয়ের এক আশ্রয় ক্যাম্পে।

বার্তা সংস্থা ইকনা: আলজাজিরার মাধ্যমে এক খোলা চিঠিতে রাখাইন সংকটে  মিয়ানমারের নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সুচিকেই দায়ী করেছেন তিনি। তার কাছে রেখেছেন বেশকিছু প্রশ্ন। তিনি মন্তব্য করেছেন, ইতিহাসে একজন সামরিক জান্তার সমান্তরালেই উচ্চারিত হবে সু চির নাম।

সেই চিঠিটি:
যে বছর আপনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান, আমার জন্ম সেই বছরেই। আমাদের দেশের (মিয়ানমার) যে কারও পাওয়া সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার এটি। রাখাইন রাজ্যের মংডুতে আমার জন্ম। আমরা সবাই সেদিন আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলাম। মনে হয়েছিলো যেন আমরা নিজেরাই পুরস্কার পেয়েছি। বছরের পর বছর সামরিক জান্তার অত্যাচারে নিষ্পেষিত মানুষ আপনার পুরস্কার পাওয়ায় নতুন করে উৎসাহ পায়, স্বপ্ন দেখা শুরু করে। ওই ঘটনায় প্রথমবারের মতো আমরা মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে আমরা গর্ববোধ করেছিলাম। প্রথমবারের মতো মনে হয়েছিলো, আমরা মিয়ানমারের মানুষ।
সব সময় আপনার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেন আমার দাদা। আপনার দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির লোকজন যখন আমাদের বাড়িতে আসত, তখন তিনি (দাদা) সবচেয়ে বড় ছাগল ও গরু জবাই করতেন। তিনি খুব উৎসাহ ভরে তাদের স্বাগত জানাতেন। নির্যাতিতদের পক্ষে আপনার সোচ্চার কণ্ঠস্বর আকৃষ্ট করেছিল আমার মাকেও। বাবা ও প্রিয় দাদা চেয়েছিলেন যেন আমি আপনার পথ অনুসরণ করি।
২০১০ সালে সামরিক বাহিনী যখন আপনাকে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি দেয় তখন আমরা খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম। কিন্তু মাত্র সাত বছরের মাথায় আমরাই, সেই রোহিঙ্গারা, বর্বরতা ও গণহত্যার শিকার হলাম। তাও আবার আপনারই হাতে। ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর আপনি দল থেকে মুসলিম নেতাদের (প্রতিনিধি) বের করে দিলেন। তখনই আপনার রাজনৈতিক ভীরুতা উন্মোচিত হয়।
কয়েক মাসের মধ্যেই আপনার প্রশাসন উত্তর রাখাইন রাজ্যে ‘জাতিগত নিধন’ অভিযান শুরু করলো। এই কয়েক মাসে অসংখ্য বেসামরিক লোককে হত্যা করা হয়েছে এবং অসংখ্য নারী সংঘবদ্ধ নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বিশ্বব্যাপী বিপুল নিন্দা সত্ত্বেও আপনি সেই অপরাধের কথা স্বীকার করেননি। এমনকি আপনি আমাদের রোহিঙ্গা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। অথচ আমরা যুগের পর যুগ এই রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছি এবং ‘রোহিঙ্গা’ই আমাদের জাতিগত পরিচিতি।
গত ২৫ আগস্ট সহিংসতা শুরুর পর থেকে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশ পালিয়ে এসেছে। এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে এবং ১৫ হাজারের বেশি বাড়িঘর জ্বালিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখনও যারা রাখাইন ছাড়তে পারেননি, তারাও রয়েছেন আতঙ্ক ও নির্যাতনের মধ্যে।
গত ১ সেপ্টেম্বর আমাকে আর আমার বাবাকে জোর করে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। ছোট্ট একটি নৌকায় করে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে আমরা তিন দিন ও দুই রাত পর বাংলাদেশে পৌঁছাই। আমাদের আশ্রয় হয় কুতুপালংয়ের একটি শিবিরে। এরপর খবর পেলাম আমাদের বাড়িটি জ্বালিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। যখন অনেকেই বলছেন যে, এটি সেনাবাহিনী কিংবা স্থানীয় বৌদ্ধরা করছে তখন আমি বলব, সু চি আপনিই এগুলো করছেন। এর জন্য আমি আপনাকেই দায়ী করব।
আমি সব সময় লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। তাই আমি বই আর বিভিন্ন লেখা পড়ে অনুপ্রেরণা পেতাম। তাই আমি বই ও আর্টিকেল পড়ে অনুপ্রেরণা পেতাম। আমি সিত্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে পড়ছিলাম, কিন্তু আপনি জানেন, সেখানে রোহিঙ্গাদের পড়াশুনা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আপনি শুধু আমার বাড়িঘরই জ্বালিয়ে দেননি, আমার বইগুলোও জ্বালিয়ে দিয়েছেন। আপনি নেলসন ম্যান্ডেলার লং ওয়াল্ক টু ফ্রিডম পুড়িয়ে দিয়েছেন। আপনি মহাত্মা গান্ধীর জীবনী পুড়িয়েছেন, আপনি পুড়িয়েছেন লিমাহ জিবোইয়ের মাইটি বি আওয়ার পাওয়ার বইটিও। এমনকি আপনি নিজের ফ্রিডম ফ্রম ফেয়ার বইটিও পুড়িয়েছেন। আমার সকল আশা ও স্বপ্নকে পোড়ানোর জন্য আমি শুধু আপনাকেই দায়ী করব।
এখন আমরা যখন বাংলাদেশে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছি তখন আপনাকে আমার বাবা একটি প্রশ্ন করেছেন, ‘সব কিছু ঘটার পরও আপনি কেন রোহিঙ্গাদের একবারও দেখতে আসেননি, হোক সেটা রাখাইন রাজ্যে কিংবা যাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য করা হয়েছে? এমনকি আপনি কি আমাদের অবস্থা সম্পর্কে একবার খবরও নিয়েছেন?
সবচেয়ে দুঃখের বিষয় যে আমরা রোহিঙ্গারা পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত সম্প্রদায়। আর তখন আমার হৃদয় ভেঙে যায় যখন আমি শুনি যে, সু চির দেশের একটি জনগোষ্ঠী পৃথিবীতে সবচেয়ে নির্যাতিত। আপনি নিজেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটা প্রত্যেকের কাছে স্পষ্ট। ইতিহাসে আপনার নাম একজন অত্যাচারী সামরিক জান্তার কাতারেই লেখা হবে। আপনি যে পথ বেছে নিয়েছেন তা আজ সবার কাছে পরিষ্কার। সবাই দেখছে- আপনার নাম হবে ‘সামরিক জান্তাসমর্থিত’ সু চি। সেই সামরিক জান্তা, যাদের কারণে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়ে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ক্যাম্পে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। এমটিনিউজ
captcha