IQNA

ব্রিটেনজুড়ে ইসলামী শিক্ষার সৌরভ

23:27 - November 08, 2018
সংবাদ: 2607161
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: দশ বছর আগের কথা। ২০০৮ সাল, মেয়েদের ব্রিটেনে নিয়ে এসেছি। জাগতিক শিক্ষার ব্যবস্থা এখানে বিশ্বমানের। কিন্তু আধ্যাত্মিক শিক্ষার ব্যাপারে কি হবে! এ ভাবনা যখন চিন্তাকে গ্রাস করে রাখলো, তখন জামেয়াতুল কাওছার নামে একটি বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পেলাম। তবে তা লন্ডন থেকে কয়েক শ’ কিলোমিটার দূরে, ল্যাংকাস্টার শহরে অবস্থিত।

বার্তা সংস্থা ইকনা: আমরা কয়েক পরিবার প্রতিষ্ঠানটি ভিজিটের সিদ্ধান্ত নিলাম। ওই প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে খুব ভোরে যাত্রা শুরু করলাম। দুপুরের আগে সেখানে পৌঁছেও গেলাম।

প্রতিষ্ঠানটির আঙ্গিনায় পৌঁছে চক্ষু চড়কগাছ। বিস্মিত দৃষ্টিতে চতুর্দিকে তাকাচ্ছি। ঘুরে বেড়াচ্ছি। সবুজ আঙ্গিনায় চোখ জুড়িয়ে গেলো। সুবিস্তৃত মাঠ, বনজ প্রকৃতি, ভিক্টোরিয়ান যুগের বিশাল অট্টালিকা, ঐতিহ্যের ছাপ ও প্রধান ফটকের কারুকাজ, সবকিছু মিলে মন আনন্দে ভরে গেলো।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনের প্যাটার্নে নির্মিত এ ভবনটি কোনো এক সময় ছিল রয়েল হসপিটাল। সময়ের বিবর্তনে এটি এখন ইউরোপের সর্ববৃহৎ বালিকা মাদ্রাসা ও মহিলা কলেজ। পশ্চিমা বিভিন্ন দেশের ছাত্রীরা এসে ইসলামের উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করে।

এখানে দারুল উলুম দেওবন্দের পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করে ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ডে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত। ১৯৯৬ সালে এ প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে। পশ্চিমা মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য আদর্শ মা ও নারী দা’ওয়া কর্মী সৃষ্টিতে এটি অনন্য ভূমিকা পালন করছে। মুসলিম কোনো দেশেও এতো সুন্দর ইসলামী প্রতিষ্ঠান পাওয়া প্রায় কঠিন।

ব্রিটেনে ইসলাম
বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ অনন্য নজির হলো ব্রিটেন। ২০১১ সালের সর্বশেষ আদমশুমারিতে ব্রিটেনে ছোট-বড় অসংখ্য ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের অবস্থানের তথ্য সুস্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। এসব সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তর জনগোষ্ঠী হলো মুসলিম ও ইসলামে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠী।

সানডে এক্সপ্রেসের (আগষ্ট ২০১৫) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্রিটেনে গির্জায় যাতায়াতকারীর চেয়ে মসজিদে আগমনকারীর সংখ্যা বেশি। ইসলামের সঙ্গে ব্রিটেনের যোগাযোগ সু-প্রাচীন। ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসার (Geoffrey Chaucer) মুসলিম বিদ্বানদের কথা তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ (Canterbury Tale)-এ উল্লেখ করেছেন। ক্রসেড যুদ্ধের পর রানি এলিজাবেথ ১ম ওসমানি সুলতান মুরাদকে স্প্যনিশ রণতরি বহরের বিরুদ্ধে ব্রিটেনকে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

জন নিলসন প্রথম ইংরেজ, যিনি ১৫৮৩ সালে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ১৬৪৯ সালে ইংরেজিতে প্রথম কুরআন অনুবাদ করেন আলেকজ্যন্ডার রস। ব্রিটেনের সর্বপ্রথম কোন মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেলেও বৃটিশ আইনজ্ঞ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব উইলিয়াম হেনরি কুইলিয়াম-র প্রতিষ্ঠিত ‘লিভরপুল মসজিদ’টি অন্যতম প্রাচীন মসজিদ। ১৮৮৭ সালে তিনি এ মসজিদ ও ‘মদিনা হাউস’ নামে একটি এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন।

অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণিতে ইসলাম বিস্তৃত হয়েছিল বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। আর ১৮৭৩ সালের পর থেকে ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে তাদের অনেক কর্মচারী ভারবর্ষ থেকে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমাতে শুরু করেন। এভাবে ধীরে ধীরে ব্রিটেনে মুসলমানদের স্থায়ী বসবাসের প্রক্রিয়া শুরু হয়। বর্তমানে প্রায় ত্রিশ লাখ মুসলিম ব্রিটেনে বাস করছেন। যা মোট জনসংখ্যার ৪.৪ শতাংশ। মূলত দক্ষিণ এশিয়া থেকে আগতরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।

ব্রিটেনে খন্ডকালীন মাদ্রাসা
মুসলমানরা, যারা নিজেদের বাসভূমি হিসেবে ব্রিটেনকে গ্রহণ করছেন, তারা মূলত দুইটি সংস্কৃতি ও দুইটি জগতের টানাপোড়েনে বাস করেন। একটি হলো নিজেদের রেখে আসা দেশের কৃষ্টি এবং দ্বিতীয়টি হলো নতুন দেশের কৃষ্টি। এ দুইয়ের মাঝে সমন্বয় সাধনে তাদের অনেক ক্ষেত্রে হিমশিম খেতে হয়। বিশেষত প্রথম দিকে যারা ইমিগ্রেন্ট হয়ে এসেছিলেন, সে সব মুসলিমদের সাংস্কৃতিক টানাপোড়েন ছিল অতিমাত্রায়। ক্রমান্বয়ে মুসলমানরা নিজেদের মতো করে একটি আবহ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন বহুলাংশে।

দারুল উলুম, প্রেস্টন, ইংল্যান্ড

প্রথম প্রজন্ম যারা এ দেশকে নিজেদের ঠিকানা করেছিলেন, তারা নিজেদের সন্তানদের শিক্ষা নিয়ে বিপদে পড়েছিলেন। মূলধারার ইংলিশ স্কুলে তাদের সন্তানরা যাচ্ছে, কিন্তু তাদের খাবার, পোশাক, নামাজ পর্দা ও নিজস্ব ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে স্কুলের পরিবেশ কোনোভাবে খাপ খাচ্ছিলনা। মুসলমানরা এ বিষয়ে চিন্তিত ও তটস্থ হয়ে উঠেছিল। তারা শহরে শহরে সংঘবদ্ধ হলো এবং কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের চাহিদাগুলো পেশ করতে লাগলো। ধীরে ধীরে স্কুলগুলো কিছুটা হলেও মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের ধর্মীয় প্রয়োজন পূরণের পদক্ষেপ নিলো। কিন্তু তা পুরো চাহিদার তুলনায় ছিল নিতান্ত অপ্রতুল। তখন মুসলমানরা নিজস্ব স্কুলে ও মাদ্রাসা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু করলেন।

বর্তমানে পুরো ইংল্যান্ডে প্রায় ১৫৬টি পূর্ণাঙ্গ মাদ্রাসা বা ইসলামিক স্কুল রয়েছে। এর মথ্যে ২৭টি স্কুল সরকারি ফান্ডে পরিচালিত আর অন্যগুলো প্রাইভেট অর্থে নির্বাহ হয়। তবে এসব প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করা কিছুটা কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। যেখানে মূল ধারার স্কুলগুলো সম্পূর্ণ ফ্রি, সেখানে মুসলিম স্কুল বা মাদ্রাসায় পড়াতে হলে অভিভাবকদের উল্লেখযোগ্য টিউশন ফি ও অন্যান্য খরচ গুনতে হয়।

তবে এসব প্রতিষ্ঠান মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের মাত্র ০.৫ শতাংশ ধারণ করতে পারে। অনেক প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ ‘অপেক্ষমাণ তালিকা’ রয়েছে। সাধারণত নতুন মুসলিম প্রজন্মের যারা বাধ্যতামূলক স্কুলে যাবার বয়সে রয়েছে, তারা মূলধারার স্কুলে যায়। তাদের ইসলামী ভাবধারা শিক্ষা ও কুরআন শেখার জন্য মুসলিম কমিউনিটি শহরে শহরে কিছু খণ্ডকালীন মাদ্রাসা গড়ে তুলেছে।

এসব মাদ্রাসা মূলত মসজিদকেন্দ্রিক। সান্ধ্যকালীন বা সপ্তাহান্তে (শনি-রোববার) এসব মাদ্রাসা পরিচালিত হয়। এ জাতীয় কয়েক হাজার মাদ্রাসা ব্রিটেনজুড়ে বিস্তৃত রয়েছে। এ ব্যবস্থাকে (Supplementary Islamic education) বলা হয়।

অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতি শেখানোর জন্য এ ধরনের প্রতিষ্ঠান সীমিত আকারে পরিচালনা করে। ইহুদিদের সিনাগগ, খ্রিস্টান এবং হিন্দু ও শিখদের মন্দিরে এ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। তবে মুসলিম স্কুলগুলো খুবই কর্মচঞ্চল ও দ্রুত বিশ্বমানে উন্নীত হচ্ছে।

লেখক: ড. শায়খ মাহমুদুল হাসান আল-আজহারিলেখক, লন্ডন প্রবাসী খ্যাতিমান আলেম ও গবেষক এবং সাবেক সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

captcha