IQNA

ভারতবর্ষে কৃষিশিল্পের বিকাশে মুসলমানদের অবদান

14:29 - September 08, 2021
সংবাদ: 3470634
তেহরান (ইকনা): ভারতীয় পোশাক ও বুননশিল্পেও মুসলিমদের অনেক বড় অবদান ছিল। মুসলিম আগমনের আগের বেশির ভাগ ভারতীয় মোটা সুতা ও অপরিশোধিত পশমের পোশাক পরিধান করত।

গুজরাটের শাসক সুলতান মাহমুদ বিন মুহাম্মদ গুজরাটি (৯১৮ হি.), যিনি মাহমুদ বিকরাহ নামে পরিচিত ছিলেন তিনি বহু শিল্পের সূচনা করেন। তাঁর হাতে তাঁত, বুটিক, সেলাই, নকশা ও কাটার কাজের বিকাশ ঘটে। এ ছাড়া তার সময়ে হাতির দাঁত, রেশমি কাপড় ও কাগজশিল্পের উন্নতি সাধিত হয়। সুলতান মাহমুদ ছিলেন একজন বড় শিল্পসাধক ও শিল্পানুরাগী শাসক। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষিতে বিপ্লব সাধিত হয়, যা সমকালীন আর কোনো শাসকের ক্ষেত্রে দেখা যায় না।

ভারতীয় ইতিহাসবিদ আল্লামা সাইয়েদ আবদুল হাই হাসানি (রহ.) লেখেন, ‘তাঁর অন্যতম অবদান হলো সমাজ ও দেশ নির্মাণ, মসজিদ-মাদরাসা ও খানকা স্থাপন, কৃষি সম্প্রসারণ, ফলদ বৃক্ষ রোপণ, ফুল-ফলের বাগান সৃষ্টি এবং মানুষকে তাতে উদ্বুদ্ধ করা; তাদের কূপ ও খাল খননে সহযোগিতা করা। এ জন্য তার রাজ্যে মানুষের ঢল নামে। বিভিন্ন অনারব অঞ্চল থেকে কারিগর, শিল্পী, নির্মাণাতা ও পেশাজীবীরা সেখানে আগমন করে এবং নিজ নিজ পেশা ও শিল্পের বিকাশে ভূমিকা রাখে।

তাঁর শাসনামলে কূপ, পানির নালা, হাউস, ফল-ফুলের বাগান, শস্যক্ষেতের সমারোহে গুজরাট সবুজের স্বর্গভূমিতে পরিণত হয়। তখন গুজরাট রূপ নেয় একটি বাণিজ্য নগরীতে, যেখান থেকে অন্যান্য অঞ্চলে উন্নতমানের কাপড় রপ্তানি হতো। এর সবই হয়েছিল গুজরাটের শাসক সুলতান মাহমুদ শাহের আন্তরিকতায়। যা দ্বারা উপকৃত হয়েছিল তাঁর রাজত্ব ও রাজ্য এবং উন্নত জীবন লাভ করেছিল তাঁর জনগণ।’ (নুহঝাতুল খাওয়াতির : ৪/৩৪৫)

সম্রাট আকবরও কাপড় তৈরির বড় বড় কারখানা স্থাপন করেন। ভূমি, ফসলি ভূমি ও স্থাবর শ্রেণিবিন্যাস, জরিপ, স্থিতিশীল ভূমি আইন ও করনীতি প্রবর্তনে মুসলিম শাসকদের অনন্য ভূমিকা রয়েছে। তাঁরা অর্থ ও মুদ্রাব্যবস্থাও গড়ে তোলেন। মুসলিম-পূর্ব ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় এসব ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা পাওয়া যায় না। বাদশাহ শের শাহ সুরি ছিলেন একজন দক্ষ শাসক ও প্রতিভাবান প্রশাসক। উন্নয়ন ও উদ্ভাবনে তিনি অন্যদের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন। সম্রাট আকবরও ছিলেন তাঁর অনুগামী।

একইভাবে ভারতে পশুপালন, পশু সংগ্রহ, জাত-উন্নয়ন ও পশুর চিকিৎসার ক্ষেত্রে ইসলামী শাসনের বিশেষ অবদান রয়েছে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী ‘তুজুকে জাহাঙ্গীরি’ এবং ‘আইনে আকবরি’তে যার বর্ণনা পাওয়া যায়। হাসপাতাল, সেবাকেন্দ্র, গণ-উদ্যান, বিনোদনকেন্দ্র, দীর্ঘ খাল ও বড় পুকুর ছিল ইসলাম শাসনের অনুগ্রহ, যা ভারতে আগে কখনো দেখা যায়নি।

আল্লামা আবদুল হাই হাসানি (রহ.) ‘জান্নাতুল মাশরিক’ গ্রন্থে ইসলামী শাসনকালে নির্মিত হাসপাতাল, জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান ও মহাসড়কগুলোর দীর্ঘ তালিকা প্রদান করেছেন। মুসলিম শাসনামলেই এমন দীর্ঘ সড়ক নির্মিত হয়েছিল, ভারতের পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে ভারত একীভূত করেছিল। তেমন একটি দীর্ঘ রাস্তা হলো গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড, যা নির্মাণ করেছিলেন শের শাহ সুরি। যা শুরু হয়েছে বাংলাদেশের সোনারগাঁ থেকে এবং শেষ হয়েছে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের ‘মায়ে নাইলাব’ নামক স্থানে গিয়ে। এই রাস্তার দৈর্ঘ্য চার হাজার ৮৩২ কিলোমিটার।

এই মহাসড়কের প্রত্যেক তিন মাইল পর পর স্থাপন করা হয় বিশ্রামাগার বা পথিক নিবাস। যেখানে হিন্দু ও মুসলিমদের জন্য পৃথক খাবারের ব্যবস্থা ছিল। প্রত্যেক তিন কিলোমিটার পরপর একটি মসজিদ ছিল। যে মসজিদের জন্য মুয়াজ্জিন, ধর্মীয় শিক্ষক ও ইমাম নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। প্রত্যেক বিশ্রামাগারে দুজন ঘোড়সওয়ার ডাকবাহক ছিল। ফলে একদিনে রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সংবাদ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হতো। সড়কের দুই পাশে ফলদ গাছ লাগানো হয়, যেন পথিক ফল খেতে পারে এবং ছায়া গ্রহণ করতে পারে।
‘আল-মুসলিমুনা ফিল হিন্দ’ থেকে আতাউর রহমান খসরুর অনুবাদ

captcha