IQNA

সুলতান মাহমুদ ও সোমনাথ মন্দির

0:01 - November 13, 2021
সংবাদ: 3470962
তেহরান (ইকনা): ভারত-বাংলাদেশের নয়, সমগ্র বিশ্ব ইতিহাসের প্রেক্ষাপটেই ইসলামের ইতিহাসের রয়েছে অসম্পূর্ণতা। এর একটা নেতিপ্রভাব পড়েছে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে। কারণ এ ক্ষেত্রে অমুসলিম ঐতিহাসিকরা তো বসে ছিলেন না। তাঁরা তাঁদের মতো করে মুসলিম-ইতিহাস রচনা করেছেন। মুসলিমদের জন্য এ ‘ইতিহাস’-এর বোঝা বহন করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে হাল আমলে।
কাল্পনিক ইতিহাসের অসত্য তথ্য কেমন করে গ্রাস করে আছে সমাজ ও সমাজের মানুষকে, দু-একটি প্রসঙ্গ এ পর্যায়ে দেখা যেতে পারে। সুলতান মাহমুদের ১৭ বার ভারত অভিযানের তথাকথিত ইতিহাসের মূল উপজীব্য বিষয় কি তিনি (গজনীর সুলতান মাহমুদ) ‘১৭ বার ভারত আক্রমণ করেছেন এবং সোমনাথ মন্দির ১৭ বারই ধ্বংস করেছেন আর ১৭ বারই লুট করেছেন মন্দিরে সংরক্ষিত স্বর্ণ’।
 
কিন্তু নানা যুগের সমসাময়িক কোনো ইতিহাসবিদ এ প্রশ্ন তোলেননি, সোমনাথ মন্দিরে কত সোনা ছিল, যা সুলতান মাহমুদকে ১৭ বার এসে তা নিতে হয়েছে অথবা প্রতিবছর এত সোনা কোথা থেকে এই অরক্ষিত মন্দিরে জমা হতো যে সুলতান মাহমুদকে ১৭ বার এসে বস্তা ভরে তা নিয়ে যেতে হলো।
 
অরক্ষিত জেনেও এমন মন্দিরে কেন এত সোনা রাখা হতো! সোমনাথ মন্দিরের কাছাকাছি কোনো সোনার খনি ছিল কি, যা থেকে এ রকম ভূরি ভূরি সোনা নেওয়ার জন্য সুদূর আফগানিস্তানের গজনি থেকে সুলতান মাহমুদকে বারবার আসতে হয়েছে।
 
সুলতান মাহমুদ সোমনাথ মন্দিরসহ অসংখ্য মন্দির ও মূর্তি ভেঙেছেন, অথচ আফগানিস্তানে সুলতান মাহমুদের আমলেই অসংখ্য বুদ্ধমন্দির ও মূর্তি ছিল, সেগুলো না ভেঙেই সুলতান মাহমুদ ভারতবর্ষে এলেন মন্দির ভাঙতে!
 
এসব প্রশ্নের জবাব প্রয়োজন। আগেই বলেছি, ইতিহাস বিষয়ে মুসলিম লেখক, গবেষক ও পণ্ডিত এবং আলেমদের মধ্যে আছে একপ্রকার নির্বিকারত্ব। আবার অনেক সময় দেখা গেছে, ‘মন্দির ও মূর্তি ভেঙেছে’ এমন প্রশ্নে সত্য-মিথ্যা না জেনেই মুসলিমরাও ভেতরে ভেতরে আত্মপ্রসাদ ও আত্মতৃপ্তি লাভ করেছে। এর ফলে সুলতান মাহমুদের বিরুদ্ধে প্রচারণাটি মুসলিম সমাজেও চ্যালেঞ্জ হয়নি। ফলে সমাজে এ রকম একটি মিথ্যা প্রচার দিনের পর দিন চলতে থাকায় তা প্রতিষ্ঠিতই হয়ে গেছে।
 
হালে ভারত-বাংলাদেশের ঐতিহাসিকদের মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনার যে সূত্রপাত হয়েছে, তা নিছক কাকতালীয় নয়। দীর্ঘদিন থেকে প্রচারিত বিকৃত ও মিথ্যা ইতিহাসের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিকদের এই নতুনতর অনুসন্ধান আস্থার একটা পরিবেশকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে।
 
প্রাচীন বাংলায় প্রথম মুসলিম আগমনের ঘটনাবলিকে এক শ্রেণির ইতিহাসবিদ যেভাবে অবজ্ঞার চোখে দেখেন, তাঁদের থেকে ঠিক বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখি প্রাচীন কোনো হিন্দু মন্দির বা বৌদ্ধ স্তূপ পাওয়া গেলে, ভাবটা এমন হয় যে প্রাচীনকালের মুসলিম কোনো ঐতিহ্য থাকতে পারে না।
 
লালমনিরহাটে ৬৩ হিজরির (৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে) নির্মিত একটি প্রাচীন মসজিদের খোদাই করা ফলক পাওয়ার পরও প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকদের নির্লিপ্ততা সবাইকেই বিস্মিত করেছে। আগে উল্লিখিত ‘সুলতান মাহমুদ’ বিষয়ক কয়েকটি নতুন মূল্যায়ন এ প্রসঙ্গে উদ্ধৃতিযোগ্য, যেখান থেকে প্রাচীন মুসলিম ইতিহাস বিষয়ে আমাদের ঐতিহাসিকদের অন্তঃসারশূন্যতা ও ব্যর্থতা অনুধাবন করা যাবে।
 
মিথ্যাশ্রয়ী ইতিহাস প্রসঙ্গে বামপন্থী লেখক আবুল বারকাত ও আহমদ ছফার জিজ্ঞাসা
 
বাংলাদেশের ‘বামপন্থী’ (সমাজতন্ত্রী) বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা ২০০১ সালে এক প্রবন্ধে সুলতান মাহমুদের সোমনাথ মন্দির ধ্বংস করার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন, যখন আফগানিস্তানে এ সময় তালেবান সরকার প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং তারা তখন প্রাচীন কুশান সম্রাট কনিষ্কের আমলের দুটি বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করে ফেলে। আহমদ ছফা এ প্রসঙ্গে লিখেছেন :
 
ভারতে মুসলিম রাজত্ব বিস্তারে যেসব মুসলিম নরপতির নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হওয়া উচিত তার মধ্যে একজন হলেন মুহম্মদ ঘোরী এবং অন্যজন সুলতান মাহমুদ। সুলতান মাহমুদ সতেরবার ভারত আক্রমণ করেছিলেন। ... তিনি সপ্তদশবারে সোমনাথ মন্দির আক্রমণ করে শ’ শ’ মণ সোনা-রূপা এবং মণি-মাণিক্য কাবুলে নিয়ে যান।
 
সাধারণত ভারতীয় ঐতিহাসিকদের অনেকেই সুলতান মাহমুদকে একবাক্যে পরধর্মবিদ্বেষী এবং মন্দির লুণ্ঠনকারী মনে করেন। সুলতান মাহমুদের ভারতবর্ষ অভিযানের সঙ্গে পরধর্মবিদ্বেষ বা মন্দির ধ্বংস করার কোনো পরিকল্পনা ছিল এ কথা মনে করা ভুল হবে।... যদি সুলতান মাহমুদ শুধু মূর্তি ধ্বংসের কারণে সোমনাথ মন্দির আক্রমণ করতেন, তার পূর্বে অবশ্যই তিনি আফগানিস্তানের বুদ্ধমূর্তি এবং মন্দিরসমূহ ধ্বংস করে ফেলতেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ইতিহাসে মন্দির এবং মূর্তি ধ্বংসকারী হিসেবে খ্যাত সুলতান মাহমুদও এই বুদ্ধমূর্তিগুলোর গায়ে কোনো রকম আঁচড় কাটেননি। (আহমদ ছফা : প্রবন্ধ সমগ্র, দ্বিতীয় খণ্ড, হাওলাদার প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৪, পৃষ্ঠা ১৬৭)
 
আহমদ ছফার এই যুক্তিটি আমরা নিতে পারি। যদি সুলতান মাহমুদ এতটাই মন্দির ও মূর্তিবিদ্বেষী হয়ে ১৭ বার এত দূরে ভারতে এসে সোমনাথ মন্দির ধ্বংস করে থাকেন, তাহলে তিনি কেন নিজ দেশের মন্দির ও মূর্তিগুলোর গায়ে একটি আঁচড়ও দেননি? ভারত-বাংলাদেশে মিথ্যা ইতিহাস এভাবে পরতে পরতে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল, যার সঙ্গে সত্যের লেশমাত্র সম্পর্কও নেই। আমাদের ইতিহাসবিদ যাঁরা মুসলিম নামবিশিষ্ট, তাঁদের থেকে এ সম্পর্কে কোনো নতুন মূল্যায়ন আমরা পাইনি। অর্থাৎ নিঃশব্দে এসব পুরনো মিথ্যা ইতিহাস এখনো তাঁরা বিশ্বাস করেন এবং ক্লাসে ছাত্রদের পড়িয়েও থাকেন।
 
সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতও বাংলার ইতিহাস রচনায় প্রচলিত ‘মিথ’ নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। বাংলাদেশে মৌলবাদের অস্তিত্ব খুঁজতে গিয়ে লেখক কয়েকটি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তিনি এ প্রেক্ষাপটে মন্তব্য করেন :
 
তরবারির শক্তি কখন কোথায় এ দেশে ইসলামকে গণধর্মে (mass religion) রূপান্তর ঘটাল(?); এমনকি সবচেয়ে বেশি রক্ষণশীল মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবও তো জোরজবরদস্তি উৎসাহ দেননি; আর মুঘল সম্রাট আকবর বৈষম্যমূলক খাজনা বন্ধ করেছিলেন এবং হিন্দু ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন আবার দ্বীন-ই-এলাহি প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও করেছিলেন ইত্যাদি। (আবুল বারকাত : বাংলাদেশে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতির অন্দর-বাহির, মুক্তবুদ্ধি প্রকাশনা, ঢাকা, জুন ২০১৮, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৯২)
 
তাই একটা সময় ধরে বাংলায় মুসলিম ইতিহাস নিয়ে যে কল্পিত চিত্র তৈরি করা হয়েছিল, তা কখনোই ইতিহাস নয়। সম্প্রতি বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন :
 
শুধু বঙ্কিমেই নয়, অন্য লেখকদের রচনায়ও এই সম্ভাব্য স্বতন্ত্র ইতিহাসের উপাদান খুঁজে পাওয়া যাবে। রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের যে বইটিকে বঙ্কিম ‘সুবর্ণের মুষ্টিভিক্ষা’ বলেছিলেন, তাতে দেখছি বলা হচ্ছে যে ভারতের অন্যত্র যা-ই ঘটে থাকুক, বাংলায় অন্তত বাহুবলের কারণে মুসলমান ধর্মের প্রসার ঘটেনি। কৃষ্ণচন্দ রায় ইংরেজ আমলের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন যে মুসলমান সুলতান বা নবাবদের সময় বাংলায় ‘এ দেশীয়দিগের উচ্চ রাজকর্ম্ম প্রাপ্তির কোনো বাধা ছিল না’। [রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় : বাঙ্গালার ইতিহাস, (কলকাতা ১৮৭৫), পৃষ্ঠা ৬১-৬২ এবং কৃষ্ণচন্দ রায় : ভারতবর্ষের ইতিহাস, ইংরাজদিগের অধিকারকাল (কলকাতা, চতুর্দশ সংস্করণ, ১৯৭৫), পৃষ্ঠা ২৪৫। পার্থ চট্টোপাধ্যায় : ইতিহাসের উত্তরাধিকার, [আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, (প্রথম প্রকাশ ২০০০), তৃতীয় মুদ্রণ, মে ২০০৯] গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃষ্ঠা ১৬৯-৭০]
 
বাংলায় মুসলিম আগমন চিত্র ও অবস্থান চারিত্র্য নিয়ে ইতিহাসবিদদের সচেতনতা হাল আমলের ঘটনা। তবে দুঃখের বিষয় হলো, মুসলিম নাম ‘বিশিষ্ট’ অনেক ইতিহাসবিদ এখনো আগের মুসলিমবিরোধী ও মুসলিমবিদ্বেষী ইতিহাসকে প্রামাণ্য জ্ঞান করছেন এবং লিখছেনও। তাঁদের মধ্যে বাহ্বা কুড়ানোর একটা অভিলাষ লক্ষ করা যায়, যাতে মুসলিম হয়েও মুসলিমদের বিরুদ্ধে (অসত্য হলেও) যাওয়াকে কেউ কেউ ‘উদারনৈতিক বুদ্ধিজীবী’ ঠাওরাবে, এখানেই যেন তাঁদের সাফল্য। কালের কণ্ঠ
captcha